কখনো মুক্তোদানা হয়ে ঝরে পড়ছে আনন্দাশ্রু

তৃতীয় কণ্ঠ:

মায়ের হাত ধরে শান্ত হয়ে বসে অধীর আগ্রহ আর  শিশুসুলভ কৌতূহল নিয়ে তন্ময় হয়ে শুনছে অভীক (নাম পরিবর্তিত) মায়ের সাথে তার প্রিয় ‘নীলা ম্যাডাম’এর কথোপকথন।  নিস্পাপ চোখ দুটিতে অদ্ভুত সুন্দর একটা দ্যূতি। মায়ের চোখে মুখে এক অপার্থিব আনন্দ, এক নতুন আশা – কখনো মুক্তোদানা হয়ে ঝরে পড়ছে আনন্দাশ্রু। স্পেশাল চাইল্ডদের বিষয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যবাংলার এই  প্রতিবেদক মুখোমুখি হয়ে পড়েন এমনি এক মধুর ক্ষণের।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

কথা হয় অভীকের মায়ের সাথে, আইএনডিআর’এর ব্যবস্থাপনা পরিচালিকা, সেন্সরি ইন্টিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ ও অকুপেশনাল  থেরাপিস্ট উম্মে সাইকা নীলা’র সাথে। কথায় কথায় বেরিয়ে আসে নানা অজানা কথা – বিশেষ শিশুদের চিকিৎসা,  তথা তাদের প্রায় স্বাভাবিক জীবনে ফেরার এক অভূতপূর্ব সাফল্যমণ্ডিত গল্পগাঁথা।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

অভীকের মা জানালেন, অভীকের বয়স ৪ বছর ৬ মাস। তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয় কিন্তু স্কুল ও বাসায় তার দৈনন্দিন আচরণগত নানা সমস্যায় তারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, ডাক্তার দেখান, যে যেখানে বলেন সেখানেই  ছুটে যান। তাদের একমাত্র সন্তানকে জীবনের স্বাভাবিক  ছন্দে ফিরিয়ে আনতে হেন চেষ্টা নাই যা তাঁরা করেন নাই, অতঃপর এক চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁরা অভীককে  আইএনডিআর’এ নিয়ে আসেন।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

শিশু বিকাশ নিয়ে কাজ করা অকুপেশনাল  থেরাপিস্ট উম্মে সাইকা নীলা জানালেন, “অভীক মূলতঃ এডিএইচডি অর্থাৎ অ্যাটেনশন ডিফিসিট হাইপার অ্যাকটিভ ডিসঅর্ডার এবং এসপিডি বা সেন্সরী প্রসেসিং ডিসঅর্ডারে ভুগছিলো, আচরণগত এই সমস্যার বিশেষত্ব হচ্ছে অমনোযোগ, বেহিসেবি দস্যিপনা ও অস্থিরতা। কোনো কিছু ঠিকঠাক শোনে না, কোনো নির্দেশ ভালোভাবে পালন করে না। কোনো কিছুতে ধৈর্য ও মনোযোগ রাখতে পারে না। একটা কাজ শেষ না করেই আরেকটি শুরু করে দেয়। অভীকের’ও এমনি নানা সমস্যা ছিলো যেগুলো তার স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো”। তিনি আরো জানালেন, “এছাড়াও অভীক সবার সাথে কথা বলতো না, অহেতুক কান্না করতো, মাকে ছাড়া কোন কাজ করতো না। রঙ চিনতো না, আকৃতিগত অর্থাৎ ছোট বড় এবং ওপর নীচ এসব সাধারণ জ্ঞান ছিলো না, সে লিখতে পারতো না, কোন ছবি রঙ করতে পারতো না, অস্বাভাবিকভাবে কথা বলতো, একটা দুটো শব্দ বলতো – পুরো বাক্য বলতে পারতো না। নিজে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারতো না, অন্যকে লাথি মারতো, থুতু নিয়ে খেলতো, চুল টানতো, স্কুল ড্রেস পড়তো না, ১ জনের অতিরিক্ত বাচ্চার সাথে খেলতো না, গাড়ী নিয়ে না খেলে শুধু গাড়ীর চাকা ঘুরাতো, ০৫ মিনিটও কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে পারতোনা”।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

এসময় অভীকের মা কান্না ভেজা কন্ঠে বলে উঠলেন, “আমাদের অভীক বাবা, মা বা তার স্কুলের নামটা পর্যন্ত বলতে পারতোনা, অথচ মাত্র এক বছরের মাথায় সে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গেলো, আমি ম্যাডামের কাছে এসে আমার ছেলের নতুন জীবন পেলাম; এখন আমার অভীক সবার সাথে কথা বলে, স্কুলে যায়, চট করে পড়া শিখতে পারে, মাকে ছাড়াই হাসি-খুশী থাকে, সহপাঠীদের সাথে খেলা করে, নিজ থেকেই মিসকে নানা প্রশ্ন করে, বাবা-মা বা স্কুলের নাম বলতে পারে, ছোট বড়, ওপর-নীচ, ডান-বাম, ভেতর-বাহির, লাল-নীল সব চেনে। সে ম্যাচিং, শর্টিং, গ্রেডিং, ক্যাটাগরি, লেখা-পড়া সব দিকেই আমার মনের মতো হয়ে উঠেছে”।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

উম্মে সাইকা নীলা

অভীকের এই সাফল্য সম্পর্কে জানতে চাইলে আইএনডিআর’এর ব্যবস্থাপনা পরিচালিকা বললেন, এ এমন নতুন কিছু নয় ভাই, আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ  দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে   জটিল মানসিক বিকাশজনিত বৈকল্য, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, ভাষা, আবেগীয় পেশি বা সেন্সরি সঞ্চালনে সমস্যা ইত্যাদি নানা ধরণের সমস্যা নিয়ে বিশেষ শিশু যেমনঃ অটিজম, এডিএইচডি, সেরিব্রাল পালসি , ডাউন-সিন্ড্রোম ইত্যাদি দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠতে আক্রান্ত বাচ্চারা আসে, সবসময়ই আমরা আমাদের আন্তরিক ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে থাকি এসব অভাগা শিশু তথা তাদের বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে”।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

তিনি আরো যা জানালেন, “আমাদের কাছে আসার পর আমরা প্রতিটি শিশুকে যথেষ্ট সময় নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে অ্যাসেসমেন্ট ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সর্বপ্রথমেই আমরা তার সমস্যাগুলো নির্ণয় করে নেই। অতঃপর তার প্রয়োজন অনুযায়ী  বিভিন্য বিশেষজ্ঞের বিশেষজ্ঞের সহায়তায় প্রত্যেকের  জন্য একটা স্পেশালাইজড এবং ইন্ডিভিজুয়ালাইজড্ থেরাপি এন্ড ম্যানেজমেন্ট প্লান তৈরি করে নেওয়া হয়, অতঃপর সে অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট থেরাপি সেশন স্থির করে সামগ্রিক পরিকল্পনাটি ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। আর বাস্তবায়নের প্রতিটি পদেক্ষেপেই রয়েছেন আমাদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত থেরাপিউটিক প্রফেশনালগণ”।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেলো, আসলে শুধু প্রথাগত অকুপেশনাল থেরাপি, সেন্সরি ইন্টিগ্রেশন, লিসেনিং থেরাপি, ফিজিওথেরাপি, ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপির মাধ্যমেই নয়, বরং সেই সাথে উচ্চ-প্রযুক্তির নিউরোফিডব্যাক ব্রেইন ট্রেইনিং, নিউরো মড্যুলেশন থেরাপি, ট্রান্স-ক্রেনিয়াল ফোটো-বায়ো-মড্যুলেশন, ট্রান্স-ক্রেনিয়াল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড থেরাপি পাশাপাশি বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল তথা আন্তরিকতা ও নিবিড় পরিচর্য্যাই ইন্সটিউট অব নিউরো ডেভলপমেন্ট এন্ড রিসার্চ (আইএনডিআর) এর সফলতার চাবিকাঠি।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

অটিজম, এডিএইচডি, সেরিব্রাল পালসি , ডাউন-সিন্ড্রোম ইত্যাদিতে আক্রান্ত বাচ্চাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া বা তাদের জীবনকে আরেকটু গুণগত মানে উন্নীতকরণ কাজটি মোটেই সহজ  নয় –  খুবই কঠিন একটি কাজ, শিশু বিকাশ নিয়ে কাজ করা অকুপেশনাল থেরাপিস্ট উম্মে সাইকা নীলা সেই কঠিন কাজটিই  দীর্ঘদিন ধরে সফল ভাবে করে  চলেছেন।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

আমাদের অনেকেরই হয়তোবা জানা নেই স্পেশাল চাইল্ডদের বাবা-মা’র বুকে নিরন্তর  স্বপ্ন বুনে  চলার নেপথ্যের সেই অন্যতম কারিগর প্রচারবিমুখ উম্মে সাইকা নীলা’র  কথা।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

দেশ বিদেশের যে কোন প্রান্ত থেকে ফোনঃ ০১৯৩১৪০৫৯৮৬ করে  অটিজম, এডিএইচডি, সেরিব্রাল পালসি , ডাউন-সিন্ড্রোম ইত্যাদি তে আক্রান্ত শিশুদের জন্য আইএনডআর’এর পরামর্শ এবং সহায়তা  পাওয়া যাবে, তিনি জানালেন।দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ

দৈনিক তৃতীয় কণ্ঠ